Custom Search

Friday, May 2, 2014

কাউন্সিলর নজরুলসহ সাতজনকে অপহরণের পর হত্যা- ছয় দিনেও কূলকিনারা করতে পারেনি প্রশাসন by শরিফুল হাসান @প্রথম আলো

সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন—সবাই ব্যর্থ। নারায়ণগঞ্জে যেন সন্ত্রাসীদেরই একচ্ছত্র আধিপত্য। প্যানেল মেয়রসহ সাতজনকে দিনদুপুরে অপহরণ, এরপর তাঁদের হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া এবং এই পরিস্থিতিতে প্রশাসনের সর্বোচ্চ সতর্কতার মধ্যে গত বৃহস্পতিবার রাতে আরেকজন ব্যবসায়ী অপহূত হওয়ার ঘটনা সরকারের সব পদক্ষেপকে অকার্যকর প্রমাণিত করেছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ ছয়জনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় গত রোববার। পরদিন থানায় মামলা করেন নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম। কিন্তু পুলিশ বা প্রশাসন তাঁদের কোনো হদিস বের করতে পারেনি। তিন দিন পর বুধবার একে একে ছয়জনের এবং পরদিন আরেকজনের লাশ পাওয়া যায় শীতলক্ষ্যা নদীতে।
রবি থেকে শুক্র—পেরিয়ে গেছে ছয় দিন। কিন্তু নৃশংস এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার তো দূরে থাক, অপরাধীদের শনাক্তই করতে পারেনি পুলিশ। নিহত ব্যক্তিদের স্বজনসহ নারায়ণগঞ্জের অনেকেই অভিযোগ করেছেন, যেভাবে প্রকাশ্যে দলে দলে মানুষকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাতে মনে হয়, এরা সাধারণ কোনো অপরাধী নয়; বরং প্রশিক্ষিত কোনো বাহিনীই এর সঙ্গে জড়িত। নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম থানায় যে অভিযোগ দিয়েছিলেন, তাতে বলেছেন, র‌্যাব পরিচয়ে তাঁর স্বামীসহ সাতজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
কিন্তু কেন খুন করা হলো সাতজনকে? পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও দ্বিতীয় প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের সঙ্গে আরেক কাউন্সিলর নূর হোসেনের বিরোধ ছিল। সেই বিরোধের জের ধরেই নজরুলকে খুন করা হয়েছে বলে দাবি করছে তাঁর পরিবার। আর বাকি ছয়জনের অপরাধ, তাঁরা খুনিদের চিনে ফেলেছিলেন। সে কারণে তাঁদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিহত সাতজনের একজন চন্দন সরকার, পেশায় আইনজীবী। ৩০ বছর ধরে তিনি আইন পেশায় জড়িত। অবসরে তিনি বাঁশি বাজাতেন, কবিতা লিখতেন। সহজ-সরল ভালো মানুষ হিসেবে সুনাম আছে তাঁর। তাঁর সঙ্গে নজরুলের কোনো যোগাযোগও ছিল না।
পরিবার ও সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোববার (২৭ এপ্রিল) বেলা দেড়টার দিকে নারায়ণগঞ্জ আদালত থেকে লিংক রোড ধরে জালকুড়ির বাসায় আসছিলেন চন্দন সরকার। আর একই সময়ে আদালত থেকে একই পথ দিয়ে ঢাকায় যাচ্ছিলেন নজরুল ইসলাম। দুজনের গাড়িই একই মডেলের (টয়োটা এক্স-করোলা)। গাড়ি দুটি খুব কাছাকাছি থাকায় নজরুলকে কারা অপহরণ করেছে, সেটি দেখে ফেলেছিলেন চন্দন সরকার। আর সে কারণেই তাঁকেও তুলে নিয়ে যায় অপহরণকারীরা। চন্দন সরকারের মেয়ে চক্ষু বিশেষজ্ঞ সুস্মিতা সরকার প্রথম আলোকে বলেন, 'আমার বাবাকে নারায়ণগঞ্জের সবাই ভালো মানুষ হিসেবে জানে। তাঁর কোনো শত্রু নাই। তাঁকে হত্যার কোনো কারণ খুঁজে পাই না।' চন্দন সরকারের গাড়িচালক ইব্রাহিমের এক বছরের একটি শিশুসন্তান আছে। তাঁর স্ত্রী হনুফা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, 'আমার স্বামীকে মারার তো কোনো কারণ থাকতে পারে না। কেন তাঁকে খুন করা হলো?'
নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন খান আলাপকালে বলেন, 'আমাকে যদি বলেন নারায়ণগঞ্জ থেকে একজন ভালো আইনজীবী ও ভালো মানুষকে খুঁজে বের করতে, সবার আগে আমি চন্দন সরকারের নাম বলব। তাঁকে খুন করার কোনো কারণ থাকতে পারে না।' তাহলে কেন তাঁকে খুন করা হলো? সাখাওয়াত বলেন, 'চন্দন সরকার হয়তো দেখে ফেলেছিলেন, কারা নজরুলকে অপহরণ করছে। আর সেটাই হয়েছে কাল।' এই হত্যাকারীরা কারা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'যেকোনো ঘটনা ঘটলেই র‌্যাব ছুটে যায়। কিন্তু চন্দন সরকার নিখোঁজ হওয়ার পর আমরা র‌্যাবের কার্যালয়ে গিয়ে তাঁর ব্যাপারে জানার চেষ্টা করি। কিন্তু র‌্যাব আমাদের ঢুকতেই দেয়নি। তাদের কাজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। কিন্তু তারা নারায়ণগঞ্জে মধুশালা পেয়েছে।' তিনি বলেন, 'নারায়ণগঞ্জের ডিসি-এসপিকে বদলি করা হয়েছে। কিন্তু তাতে মানুষের আস্থা ফেরেনি। আমরা চাই, র‌্যাবের অধিনায়ক থেকে শুরু করে সবাইকে এখান থেকে বদলি করা হোক। আর যদি কেউ এই খুনের সঙ্গে জড়িত থাকে, তাহলে তাকে গ্রেপ্তার করে বিচার করা হোক। এভাবে একটি দেশ চলতে পারে না।'
নারায়ণগঞ্জের একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, 'লিংক রোডের যে জায়গা থেকে দিনের বেলা তাঁদের তুলে নেওয়া হয়, সেই রাস্তায় সব সময় লোক থাকে। আর সাতজন লোককে অপহরণ করতে হলে ২০ থেকে ২৫ জন লোক এবং কয়েকটি গাড়ি দরকার। আবার নজরুলের কাছে বেশির ভাগ সময়ে অস্ত্র থাকে। কাজেই সাধারণ কোনো সন্ত্রাসী বাহিনী অপহরণ করতে এলে সেখানে সংঘর্ষ বেধে যেত। কাজেই প্রশিক্ষিত কোনো বাহিনী ছাড়া এ ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়। ওই বাহিনী যখন নিজেদের পরিচয় দিয়েছে, তখন আর কারও কথা বলার সাহস থাকে না। তা ছাড়া সাতজনকে হত্যা এবং তাঁদের শরীরে ইট বাঁধা হয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে।' এ ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে জেলা পুলিশ সুপার খন্দকার মোহিদ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত চলছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশেনর মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী প্রথম আলোকে বলেন, 'একের পর এক গুম-হত্যার ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের মানুষ এখন আতঙ্কে আছে। এখনাকার পুলিশ, প্রশাসন সবাই যেন ব্যর্থ। এখানে যাঁরাই দায়িত্ব পালন করতে আসেন, প্রভাবশালী কিছু মানুষের কাছে জিম্মি হয়ে যান। কিন্তু মানুষ স্বস্তি চায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সবার কাছে অনুরোধ, আপনারা ব্যবস্থা নিন। নারায়ণগঞ্জের মানুষকে রেহাই দিন।' র‌্যাবের তিন কর্মকর্তাকে ফেরত: একসঙ্গে সাতজনকে অপহরণ ও হত্যা ঘটনার পর র‌্যাবের অধিনায়কসহ তিনজনকে নিজ নিজ বাহিনীতে ফেরত পাঠানো হয়েছে। গত বুধবার এ তিন কর্মকর্তার দুজন সেনাবাহিনী ও একজন নৌবাহিনীতে যোগ দেন।
র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি সিদ্ধান্ত অনুসারে এসব কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। বদলি হওয়া তিন কর্মকর্তা হলেন, র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাইদ মাহমুদ, মেজর আরিফুর রহমান ও লে. কমান্ডার মাসুদ রানা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও এক আইনজীবীসহ সাত ব্যক্তি অপহরণের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক বৈঠকে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরপরই র‌্যাব কর্মকর্তাদের সরানো হয়। একই সিদ্ধান্তে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকেও সরিয়ে দেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, গত বছরের আগস্টে র‌্যাব-১১ এর পরিচালক হিসেবে যোগ দেন তারেক সাইদ। এরপরই লক্ষ্মীপুরে রক্তাক্ত অভিযান চালায় র‌্যাব। এই অভিযানে র‌্যাবের বিরুদ্ধে মিছিলে গুলি চালিয়ে এক যুবদল নেতাকে হত্যা করে লাশ গুমের অভিযোগ ওঠে। ওই সময় বিক্ষুব্ধ বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মীরা র‌্যাবের দলটিকে দিনভর লক্ষ্মীপুর পুলিশ লাইনে অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার গিয়ে তাঁদের উদ্ধার করে।
২৭ এপ্রিল
দিনদুপুরে অপহূত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজন
৩০ এপ্রিল
দুপুরে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করা হয় তাঁদের ছয়জনের লাশ। বৃহস্পতিবার সকালে পাওয়া যায় আরও একজনের লাশ
১ মে
রাতে অপহূত হন ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম। ২৪ ঘণ্টা পর তাঁকে গত রাত সাড়ে ১১টায় সাভারের নবীনগরে ফেলে যায় অপহরণকারীরা

No comments: